পোভার্টি পর্ন: সহানুভূতির নামে মুনাফা

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় “মানবতার ফেরিওয়ালা” একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে, আর যারা এই মানবতার ফেরিওয়ালা, তাদের ফলোয়ার্স সংখ্যাও কম নয়। তবে এই মানবতার ফেরিওয়ালাদের মধ্য থেকেই এসেছে একটি শব্দ—”Poverty Porn”। অনেকের কাছেই এই শব্দটা নতুন হতে পারে, কারণ মিডিয়া এই দিকটা প্রায়ই এড়িয়ে যায়। তবে রাজনীতিবিদরাও এই “Poverty Porn”-এর একটি বড় অংশের সাথে যুক্ত।” Poverty Porn” হল গরীব মানুষের দুঃখ-কষ্টকে দেখিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করা। অর্থাৎ, ছবি তুলে, লেখা বা ভিডিও বানিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে মানুষের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে কেউ তার অনলাইন চ্যানেলের ভিউ বা ফলোয়ার বাড়ায়, কেউ সংবাদপত্র বিক্রি করে, কেউ চ্যারিটির জন্য তহবিল সংগ্রহ করে, আবার কেউ ভোট পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। এছাড়াও অনেক নিউজ চ্যানেল তাদের TRP বাড়ানোর জন্য এই কৌশল ব্যবহার করে। সোজা কথায়, Poverty Porn হল গরীবদের দুঃখ-কষ্টকে পুঁজি করে ব্যবসা করার একটি মাধ্যম।

Poverty porn এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট আছে। প্রথমত, এর প্রধান উপাদান হলো “সেন্সেশন অ্যাওয়্যারনেস”। উদাহরণস্বরূপ, বেশিরভাগ কন্টেন্ট এ দেখবেন ভিকটিমদের চোখে জল নিয়ে ক্যামেরা জুম ইন করা, বা ভাঙা ঘরে বসে থাকা, এক পরিবারের দিকে বারবার ফোকাস দেওয়া, তার সাথে ইমোশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক—এগুলো দর্শকদের মধ্যে সহানুভূতি জাগানোর চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ত, এখানে গরিব মানুষদের “একমাত্রিক চরিত্র” হিসেবে দেখানো হয়। তাদের সংগ্রাম, স্বপ্ন, প্রতিবাদ , নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা উপেক্ষিত করা হয়। যেমন: অনেক ভিডিওতে দেখবেন পরিবারের একজন মাকে শুধু “ভিকটিম” হিসাবে দেখানো হয়, কিন্তু তার প্রতিদিনের লড়াই বা স্বাধীন চিন্তাভাবনা ক্যামেরাবন্দি হয় না। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো কনটেক্সট (প্রাসঙ্গিকতা) এর অভাব। দারিদ্র্যের কারণ হিসেবে সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো, বৈষম্য বা নীতির ব্যর্থতা না দেখিয়ে শুধু ব্যক্তির “দুর্ভাগ্য” বা “অলসতা”কে দায়ী করা হয়। চতুর্থত, ইমোশনাল ম্যানিপুলেশন—ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, লাইটিং, এডিটিংয়ের মাধ্যমে দর্শকদের স্ক্রিনে ইমোশনালি আকৃষ্ট করে রাখে।

পোভার্টি পর্নের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো দ্রুত অ্যাটেনশন ক্যাচ করা। মিডিয়া হাউজগুলো আর কন্টেন্ট ক্রিয়েটর গুলো জানে একটি কষ্টদায়ক ইমেজ ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই টিআরপি, ভিউ ফলোয়ার পাওয়ার জন্য গরিব মানুষের দুর্দশাকে পণ্য বানানো হয়। অন্যদিকে, এনজিও বা চ্যারিটি সংস্থাগুলো ডোনেশন বাড়ানোর জন্য এই ট্রিকস ব্যবহার করে। সমস্যা হলো, এতে করে সাহায্যকারীরা উদ্ধারকারীর মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন, যা পাওয়ার ডাইনামিক্সকে আরও বৈষম্যমূলক করে তোলে। আরও ভয়ংকর ব্যবহার দেখা যায় ট্যুরিজম সেক্টরে—”বস্তি পর্যটন” নামে ধনী পর্যটকদের গরিব এলাকায় ঘুরিয়ে আনা হয় তাদের “এক্সোটিক” জীবন দেখাতে, যা মূলত পর্যটকদের ফটো অ্যালবামের শোপিসে পরিণত হয়।রাজনীতিতে ভোট পাওয়াই সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। আর ভোটারদের মন জয় করতে রাজনৈতিক দলগুলো নানা কৌশল ব্যবহার করে। ‘প্রোভার্টি পর্ন’ তার মধ্যে একটা।

Proverty Porn সমাজে একধরনের সিমপ্যাথি ট্রিগার তৈরি করে, যা রাজনৈতিক নেতাদের জনসমর্থন লাভের পথ সুগম করে। রাজনীতিবিদরা পোভার্টি পর্নকে সরাসরি এজেন্ডা প্রমোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় সময়ই বিরোধী দলগুলো দাবি করে “বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশে দারিদ্র্যতার হার ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। “তার সাথে তারা মিডিয়ায় গরিব মানুষের দুর্দশার চিত্র বারবার প্রচার করবে, কিন্তু সেই দারিদ্র্যের পেছনের প্রধান কারণগুলো,নীতি বা কর্পোরেট এক্সপ্লয়েটেশনের ভূমিকা এড়িয়ে যাবে।অন্যদিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল Proverty Heroism -এর ন্যারেটিভ তৈরি করে। যেমন, একজন রিকশাচালক কীভাবে অসম্ভব পরিশ্রম করে সন্তানকে ডাক্তার বানালেন।

এই গল্পটি অনুপ্রেরণাদায়ক হলেও এটি তার শানামলের systemic failure ঢাকতে ব্যবহৃত হয়। যেন দর্শকরা ভাবেন, “ব্যক্তির প্রচেষ্টাই যথেষ্ট, ব্যবস্থা পরিবর্তনের দরকার নেই”। এই পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো ইস্যুগুলোর গভীরে যাওয়া বা টেকসই সমাধানের চেয়ে আবেগকে প্রাধান্য দেয়, যাতে ভোটাররা যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের বদলে তাৎক্ষণিক সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে “পোভার্টি পর্ন” রাজনৈতিক ম্যানিপুলেশনের একটি সাবটুল হিসেবে কাজ করে, যেখানে দারিদ্র্যর বাস্তব সমস্যা সমাধানের চেয়ে তার প্রতীকী ব্যবহারই প্রাধান্য পায়।

এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, আর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে নিজেকে সাধারণ মানুষের মুক্তিদাতা হিসেবে তুলে ধরে।তবে, এ থেকে বেরিয়ে আসার কিছু কার্যকর উপায় রয়েছে। এর জন্য আমাদের উপস্থাপনা বা “Dignified Storytelling”-এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। দরিদ্র মানুষের কেবল দুর্দশা নয়, তাদের সংগ্রাম, আত্মনির্ভরতা এবং সাফল্যের গল্প তুলে ধরে, কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধানে কাজ করতে হবে। মিডিয়া, দাতা সংস্থা এবং এনজিওগুলোকে আবেগপ্রবণতার বদলে বাস্তব এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এবং দারিদ্র্যের মূল কারণগুলো তুলে ধরতে হবে। তবেই আমরা সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারব এবং মানবিকতা ও মর্যাদা সঙ্গতভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *